কাঞ্চন ব্রিজ থেকে ঢাকা নগর বাইপাস দিয়ে খানিকটা এগোলে মাটির ঘর রেস্টুরেন্ট। মূল সড়কের কাছেই এর অবস্থান। গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে ছনে ঢাকা গোল ছাউনি। রেস্টুরেন্টের এক পাশে রয়েছে পার্কিং লট। সেটা পেরিয়ে সোজা এগোলে রসাতল। এটি রেস্টুরেন্টেরই ছোট্ট একটি অংশ, রসাতলে কেবল রয়েছে পানির ব্যবস্থা। এখানে পাবেন বিভিন্ন ধরনের চা, কয়েক প্রকার ফলের জুস ও কফি।
বর্তমানে এই এলাকায় রেস্টুরেন্টটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এর জনপ্রিয়তা শুধু এখানেই নয়, সোশ্যাল মিডিয়াতেও মাটির ঘরের জনপ্রিয়তা বেপক। তাই এর অবস্থান গাজীপুরে হওয়া সত্ত্বেও এই রেস্টুরেন্টে প্রতি সপ্তাহের ছুটির দিন গুলোতে রীতিমতো ভোজন রসিকদের মেলা বসে।
পুরো এলাকায় প্রায় তিন বিঘা হলেও রেস্টুরেন্টের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে কেবল একখানা টিনের চারচালা মাটির ঘর। ছোট্ট স্টল পেরিয়ে ঢুকলে প্রথমে পড়ে রসুইঘর। ঘরটি বেশ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। মূলত ভাজাভাজির কাজ হয় সেখানে। সেটা পেরিয়ে প্রবেশ করলে হাতের বামে দেখা মিলবে মাটির তৈরি সারি সারি খাবারের বাটি। সেগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে বাঁশের সরপোশ দিয়ে। তারপর কাউন্টার। সেখানে মাধবের মুরালি রাখা হয়েছে দুটো কাচের বয়ামে। এরপরেই আরেকটি দরজা, সেটা দিয়ে বের হলে হাত ধোয়ার বেসিন। বাকিটা অতিথিদের বসার জায়গা। প্রায় ৩৩ জন একসঙ্গে এখানে বসে খেতে পারেন। টেবিলগুলো সবই কাঠের তক্তা দিয়ে বানানো, চেয়ারগুলো গাছের গুঁড়ি কেটে। বড় জানালা রয়েছে ৬টি, দুই প্রান্তে দুটো গোল জানালা, আর ভেন্টিলেশনের জন্য চারটি ছোট। মাথার ওপরে হারিকেন দিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। রয়েছে ছোট ছোট অনেকগুলো ফ্যান, বাঁশের বর্গার সঙ্গে ঝোলানো। আর একদম শেষ প্রান্তে দুটো বাবুই পাখির বাসা। ময়লা ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি আর চাপালি দিয়ে। টেবিলে মাটির জগ-গ্লাস রাখা, এমনকি খাবার পরিবেশনও করা হয় মাটির থালায়।
রেস্টুরেন্টের কর্ণধার বিপ্লব আকন্দ বললেন, মূলত এটা ছিল আমার দাদার বাড়ি, সেখানে কিছু একটা করতে হবে, এটাই ছিল মূল পরিকল্পনা। কিন্তু এখানে করা য়ায়, সেটা নিয়ে অনেক গবেষণার পর আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার চিন্তা। বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া, কাজ করে খাওয়া, পথ শিশুরা হবে সেখানের শিক্ষার্থী। তবে এ যুগে এখানে তো গৌরী সেন নেই, তাই রেস্টুরেন্ট থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়েই হবে সেই স্বপ্নের স্কুল। আর মাটির ঘরের ব্যাপারটা পুরোটাই তার নিজের শখের। ইট-পাথরের বাড়ি তৈরির ভিরে হারিয়ে যাচ্ছে মাটির ঘর। তাই এই মাটির বাড়ি টিকিয়ে রাখার জন্যই রেস্টুরেন্টি তৈরি করা। তবে বড় গোল জানালা নির্মাণ নিয়েই আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল, একে তো যারা এই মাটির ঘর তৈরি করে তারা প্রায় ভুলতে বসেছেন আদি পেশা। তবে সকল বাধা-বিপত্তি পিছনে ফেলে এখন মাটির ঘর রেস্টুরেন্ট সবার নজরে। আনন্দের ব্যাপার হলো, শুরুতে কোনো নাম ছিল না। কেউ একজন গুগল ম্যাপে এই জায়গাটাকে মাটির ঘর রেস্টুরেন্ট নামে লোকেশন ট্যাগ করার পর থেকেই তা চালু হয়ে যায়। সেটাই চলছে এখনো। রেস্টুরেন্ট মূলত দুপুরের খাবারের জন্যই। রাতে ভোজনের ব্যবস্থাও করা হয়, আগে থেকে ফোন দিয়ে রাখলে। তবে দুপুরে গেলেও ফোনে রিজার্ভেশন রাখাটাই ভালো।
মাটির ঘরে দুপুরে খাবারের জন্য রয়েছে বিরই চালের ভাত, ইলিশ মাছ ভর্তা, কচুমালার চপ, পুঁটি শুঁটকির সিঁদল, শিমবিচি দিয়ে দেশি মুরগি, বাটা মাছের পাতুরি, তেঁতুল টকে পঞ্চপদী ডাল, শসা, টমেটো, ধনেপাতা, কাচামরিচ দিয়ে মাখানো একটি মজাদার স্যালাড। প্রথমেই ক্ষুদার্থ হিসেবে বিরই চালের ভাত আর পুঁটি শুঁটকির সিঁদল দিয়ে খেলাম। এরপর কচুমালার চপেই কামড় দিলাম, না জানা থাকলে অনায়াসে যেকোনো আমিষ বলে চালিয়ে দেওয়া যেতে পারে বেসনে ভাজা এই অতি সাধারণ সবজি। নেত্রকোনার দিকে নাকি এটি খুব জনপ্রিয়। কাঁচা মরিচের ঝাঁজে অসাধারণ স্বাদ। এটিও উত্তরাঞ্চলের খাবার। ইলিশ মাছের ভর্তাটাও খুব মজাদার। তাই নির্ভয়ে খাওয়া যায়, আর তার সঙ্গে যদি যোগ হয়ছে বাবুর্চির মুনশিয়ানা। সাধারণত বড় মাছের পাতুরিই খাওয়া হয় সব সময়, তবে কাঁটার আঘাত সহ্য হলে বাটা মাছের পাতুরিও অনবদ্য এক পদ হতে পারে ভাতের সঙ্গে। সবশেষে শিমের বিচি দিয়ে দেশি মুরগি। এই পদটা একটু অন্যরকম, তবে বেশ মজাদার। শিমের বিচি দিয়ে এর আগে শুঁটকি খেয়ে দেখা হয়েছে গ্রামাঞ্চলে। তবে শিমের বিচি দিয়ে মুরগি এই প্রথম খাওয়া। মুরগিতেও যে শিমের বিচি এমন দারুণ সঙ্গ দিতে পারে, তা কে জানত! এরপর ডাল দিয়ে খাওয়া শেষ করার পালা, তেঁতুলের টক আর নানা পদের ডাল মিলে অসাধারণ এই পদটাও। বিরই চালের ঝরঝরে ভাত খেয়ে মনে হলো, একটা ভাতঘুম দেওয়ার ব্যবস্থা হলে মন্দ হতো না! জানা গেল, যতটা সম্ভব প্রতিটি শস্যই প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা কি না, তা নিশ্চিত করে কেনা হয়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছি হ্যামকে, আম-কাঁঠালের ছায়ায়, ঘুম ঘুম একটা ভাব চলে আসে। রসাতলের একটু পাশেই রয়েছে খোলা জায়গা, সেখানে কিছু কাঠের বেঞ্চি আর হ্যামক রাখা। শেষ প্রান্তে আছে একটি মন মুগ্ধকর কুঁড়েঘর, ছনের ছাওয়া। পুরোটাজুড়ে গাছের সমারোহ। অর্কিড, মানিপ্ল্যান্ট, সেনসেভেরিয়া, কচু, পাম, আম, কাঁঠাল, কামিনী, দাতিনা, বাঁশ, সহ আরও অনেক গাছে। এখানে পোষা কবুতরের আনাগোনাও রয়েছে। মাটির ঘরের দরজার ঠিক আগেই একটা ছোট্ট একটি দোকান রাখা হয়েছে। ছোট্ট এই স্টলটিতে পাওয়া যায় হ্যান্ডপেইন্ট টি-শার্ট, হ্যান্ডিক্র্যাফট, এগুলো মূলত আশপাশের গ্রামের নারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা।
দুপুরে খাওয়ার পর পেটে আর জায়গা ছিল না। পেটে যদি ওষুধের জন্য আর একটু জায়গা থাকত, তবে ইলিশ মাছের ভর্তা দিয়ে আরেক মুঠো ভাত খেয়ে নিতাম। তাই খেজুর গুড়ের মহিষের দই বা কফি দই চেখে দেখা হয়নি। তবে মেইন কোর্সের অনবদ্য পারফরম্যান্সের পর তা নিয়ে কোনো সন্দেহ পুষে না রাখাই শ্রেয়। খাওয়া শেষে বিপ্লব শুধোলেন, কোনো সাজেশন? শুধু বলতে পেরেছিলাম- গ্রামের এই স্বাদ অটুট রাখুন, অবিকৃত রাখুন, তবেই চলবে।
ঠিকানা: মাটির ঘর, ঢাকা সিটি বাইপাস, ১৭২০ পানজোরা। (৩০০ ফুট কাঞ্চন ব্রিজ থেকে হাতের বামে ৭ কিলোমিটার)।###