চট্টগ্রামে শীর্ষ সন্ত্রাসীর তকমা পাওয়া ছোট সাজ্জাদ যেমন, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তার স্ত্রী তামান্না শারমিনও তেমনই। বরং স্বামীর চেয়ে স্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে। চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, বায়েজিদ বোস্তামি, খুলশি ও চান্দগাঁও এলাকার ত্রাস ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদ।
ফেসবুক লাইভে এসে সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ‘ওসিকে ন্যাংটা করে পিটুনির’ হুমকি দিয়েছিলো। আর তাকে গ্রেফতারের পর তার স্ত্রী তামান্না শারমিন ফেসবুক লাইভে এসে ‘কাঁড়ি কাঁড়ি-বান্ডিল বান্ডিল টাকা দিয়ে স্বামীকে জামিন করানো হবে’ বলে জানান। স্বামী-স্ত্রী দুজনের এমন হুঙ্কারের বিষয়টি চট্টগ্রামে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
এলাকাবাসী জানান, রাউজান এবং রাঙ্গুনিয়া এলাকায়ও সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদ আতঙ্কে তটস্থ সাধারণ মানুষ। মুরগির দোকানের কর্মচারী থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী হওয়া সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না শারমিন। তামান্নার বয়স প্রায় ৩৫। বাড়ি নগরীর সদরঘাট থানার মাদারবাড়ি এলাকায়। তার মা-বাবা বেঁচে আছেন। তবে তামান্নার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তার পেশা ড্যান্সার বা নর্তকী। দুবাইয়ের বিভিন্ন নাইট ক্লাবে ড্যান্স করেন তিনি। ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাই গিয়ে মাস তিনেক অতিবাহিত করেন। সেময় বিভিন্ন নাইট ক্লাবে ড্যান্সার হিসাবে চাকরি করেন। এরপর আবার দেশে ফিরে আসেন। পরবর্তীতে একইভাবে আবারও দুবাই যান।
৫-৬ মাস আগে রাউজানের একটি মসজিদে কাজী ডেকে তামান্না বিয়ে করেন সাজ্জাদকে। পুলিশি তৎপরতা থাকায় ওইদিন তাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া বাইরের কাউকে থাকতে দেওয়া হয়নি। এটি তামান্নার তৃতীয় বিয়ে, আর সাজ্জাদের দ্বিতীয়। সাজ্জাদ প্রথমে শিলা নামে তৃতীয় লিঙ্গের একজনকে বিয়ে করে। শিলার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলায়। তবে সে তৃতীয় লিঙ্গের হওয়ায় পরিবারের সঙ্গে হাটহাজারীতে বসবাস করত না।
২০২২ সালের পর ট্যুরিস্ট ভিসায় দুবাইয়ে যায় তামান্না। দুবাইয়ে সে বিভিন্ন ক্লাবে নাচতো। শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদও দুবাই যেতো। সেখানে ড্যান্স ক্লাবে তাদের পরিচয় হয়। সে থেকেই তাদের মধ্যে সক্ষতা গড়ে উঠে। তবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝামেলার কারণে ২০২৩ সালের দিকে তাদের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ২০২৪ সালের শুরুতে আবার সম্পর্ক গভীর হয়।
তামান্না এর আগে আরও দুই বিয়ে করেছে। প্রথম বিয়ে করে ২০০৭ সালের দিকে। ওই ঘরে রোহান নামে ১৭ বছরের একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। এরপর ২০১৮ সালের শেষের দিকে আরও একটি বিয়ে করে তামান্না। এ ঘরে একটি সন্তান রয়েছে বলে জানা গেছে। আগের দুই স্বামীই সামাজিকভাবে ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিত বলে তামান্নার আত্মীয়স্বজনরা জানিয়েছেন। তামান্নার সঙ্গে প্রথম স্বামীর তেমন যোগাযোগ নেই। তবে পরের স্বামীর সঙ্গে এখনো যোগাযোগ রয়েছে। সাজ্জাদকে বিয়ে করার পর অক্সিজেন এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বাস করত তারা দু’জন।
ছোটকালেই মা-বাবা মারা যাওয়ায় অসহায় অবস্থায় বড় হয়েছে সাজ্জাদ। এরপর নজু মিয়ারহাট এলাকায় একটি মুরগির দোকানে কর্মচারী হিসাবে চাকরি নেয় সাজ্জাদ। কয়েক বছর ওই দোকানে চাকরি করে। পরে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে চট্টগ্রামের এক সময়ের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী খানের অনুসারী হিসাবে। তাই তাকে অনেকে ছোট সাজ্জাদ বলে ডাকে। আলোচিত এইট মার্ডার মামলায় দণ্ডিত সাজ্জাদ আলী খান ২০০০ সালে একে-৪৭ রাইফেলসহ গ্রেফতার হয়েছিল। ২০০৪ সালে জামিনে বেরিয়ে সে বিদেশে পালিয়ে যায়। তবে নগরীর বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, চান্দগাঁও ও হাটহাজারী এলাকায় এখনো কেউ নতুন বাড়ি নির্মাণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি বেচাকেনা করলেই ফোন আসে সাজ্জাদের। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলে শিষ্যদের দিয়ে হামলা করায়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে এভাবেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে পলাতক সাজ্জাদ। বিদেশে থাকলেও ছোট সাজ্জাদকে শিষ্য হিসাবে গড়ে তুলে দেশে তার চাঁদাবাজির ‘স্বর্গরাজ্য’ টিকিয়ে রেখেছে। এখন ছোট সাজ্জাদই চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ, বায়েজিদ, খুলশি ও চান্দগাঁও এলাকার ত্রাস ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদ। এছাড়াও রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া এলাকার মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল সে।
শনিবার রাতে ঢাকার বসুন্ধরা সিটি থেকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) একটি টিম তাকে গ্রেফতার করে। এরপর লাইভে এসে সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না বলে, ‘হ্যাঁ আমার জামাই গতকাল রাতে অ্যারেস্ট হয়েছে। এটা নিয়ে এত হায়-উল্লাস করার কিছু নেই। ঠিক আছে। মামলা যখন আছে অ্যারেস্ট হবেই। এগুলো নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করার, কান্নাকাটি করার কিছু নেই। আপনারা যারা ভাবতেছেন আমার জামাই আর কোনো দিন বের হবে না। ওদের জন্য এক বালতি সমবেদনা। আমরা কাঁড়ি কাঁড়ি, বান্ডিল বান্ডিল টাকা ছেড়ে আমার জামাইকে নিয়ে আসব। আমার জামাই বীরের বেশে চলে আসবে। যারা এ ঘটনা ঘটাইছে (গ্রেফতার করেছে) তাদের ছাড় দেওয়া হবে না। মাথায় রেখো। এতদিন আমরা পলাতক ছিলাম। এখন তোমাদের পলাতক থাকার পালা। আমার জামাই আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে আমার কাছে চলে আসবে। তখনই খেলা শুরু হবে। খেলা মাত্র শুরু করেছ তোমরা। শেষ করব আমরা। ঠিক আছে? আমার জামাই সাজ্জাদের যারা সাপোর্টার আছে, আমার জামাইয়ের জন্য দোয়া করো- যেন ১০-১২ দিনের মধ্যে জামিন করে ফেলতে পারি। ধন্যবাদ।’
পুলিশের একটি সূত্র জানান, গ্রেফতারের সময় সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী তামান্না পুলিশকে ২০ লাখ টাকা অফার করে। কিন্তু তাদের সেই অফার গ্রহণ করেনি পুলিশ। সিএমপির উত্তর বিভাগের ডিসি আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন টিম তাকে গ্রেফতার করে রোববার চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। তাহসিন হত্যা মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে আনার পর ছোট সাজ্জাদকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে পুলিশ। ছোট সাজ্জাদকে অল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টিকে সিএমপি কমিশনারের বড় ধরনের সাফল্য বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।